‘শান্তিপূর্ণ ভোট ডাকাতি’ এবং ভোটারদের মনোকষ্ট -মীর আব্দুল আলীম (২৫ /০৪/২০১৪)
মী র আব্দুল আলীম : <p>‘শান্তিপূর্ণ ভোট ... ...বিস্তারিত
10 Apr, 2014
22 December, 2024
বিশুদ্ধ পানি: একটি মানবাধিকার সংকট
বিশুদ্ধ পানি সব ধরনের মানবাধিকারের ভিত্তি হিসাবে স্বীকৃত। মানুষের জন্য বিশুদ্ধ উন্নত পানি সরবরাহ এখনো সীমিত পর্যায়েই রয়েছে। মলের জীবাণু রয়েছে, এমন পানি পান করছে এদেশের ৪১ শতাংশের বেশি মানুষ। শহরাঞ্চলের যে পানি খাওয়া হয় তার এক-তৃতীয়াংশেই উচ্চমাত্রার ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা ডায়রিয়ার প্রধান একটি কারণ। পাহাড়ি এলাকা, শহর, বস্তি, দ্বীপাঞ্চল, উপকূলীয় ও জলাভূমিতে এই পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এসব জায়গায় বিশ্বাসযোগ্য পানির উত্স পাওয়া কঠিন। সব মিলিয়ে পুরোপুরি নিরাপদ পানি পানের সুযোগ এখনো সীমিত, মাত্র ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। অগ্রগতি সত্ত্বেও ১ কোটি ৯৪ লাখ মানুষ এখনো সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। এছাড়া পানিতে ম্যাঙ্গানিজ, ক্লোরাইড ও লৌহদূষণের কারণেও খাওয়ার পানির মান খারাপ থাকে। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ পানির উত্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে ২০১৫ সালে যত নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে তার প্রায় ২০ শতাংশই হয়েছে জীবাণু সংক্রমণের কারণে। প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে দুটি, অর্থাৎ বাংলাদেশের ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া দূষিত পানি পান করে। আবার ঘরের কল বা টিউবওয়েলের আশপাশ পরিষ্কার না থাকায় বিভিন্ন অণুজীবযুক্ত পানি পানকারীর সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৯০ লাখ। এ ছাড়া ঘনঘন বন্যা, ভূমিধস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও পানির উত্স দূষিত হয়ে পড়ে।
শিল্পবর্জ্য, সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং জমিতে লবণাক্ত পানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণও বাংলাদেশে পানির গুণমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটছে না। দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে। বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় পানির সংকট অত্যন্ত প্রবল। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.০৭ শতাংশ, বছর-প্রতি এই বিপুল হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও পানিসম্পদ কিন্তু একই থাকছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে প্রচুর মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে পড়বে।
পানির সমস্যা যে কেবল বাংলাদেশের, তা অবশ্য নয়। বলতে গেলে সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী। বলা হয়ে থাকে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি কখনো বাধে তা হলে তা বাধবে পানি নিয়ে। বিশ্ব জুড়ে পানি সংকটের কারণ যতটা না প্রকৃতিগত, তার চাইতে অনেক বেশি মনুষ্যসৃষ্ট। বিশ্বের ২৬০টি দীর্ঘ ও বৃহত্ নদী দুই বা ততোধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নদনদীর পানি ব্যবস্থাপনা ছাড়াও পরিবেশ-প্রতিবেশগত আরো নানান কারণে দুনিয়ার দেশে দেশে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে এরই মধ্যে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াটার কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ আজ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত। পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে ৩৯ হাজার শিশু মারা যায় পানিবাহিত রোগে। ডায়রিয়ায় মারা যায় ১০ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। বলা বাহুল্য, ডায়রিয়া রোগের প্রধান কারণ দূষিত পানি। এরই মধ্যে বিশ্বের ৮৯ শতাংশ মানুষ পরিষ্কার পানি পাচ্ছে। বিশেষ করে, চীন ও ভারতে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পানি সরবরাহেরও উন্নতি হয়েছে।
২০১৫ সাল নাগাদ ৯২ শতাংশ মানুষের কাছে পরিষ্কার পানি পৌঁছে দেওয়া যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেছিল জাতিসংঘ। কিন্তু সে লক্ষ্যে এখনো পৌঁছা যায়নি। বিশ্বের জনসাধারণের একটা বিরাট অংশ, অর্থাৎ ১১ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান থেকে বঞ্চিত। অন্য কথায়, পৃথিবীর প্রায় ৮০ কোটি (৭৮৩ মিলিয়ন) মানুষ প্রতিদিন দূষিত পানি পান করছে।
জাতিসংঘে সুপেয় পানির অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সেখানে লক্ষ করা যায় যে, শুধু কাগজে-কলমে আইন করে কাজ হয় না। এজন্য প্রয়োজন বিশেষ কলাকৌশলের। পৃথিবীর চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগ পানি। কিন্তু এই বিশাল পরিমাণ পানির মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ পানি পান করার যোগ্য। আবার এই পানির একটা বড় অংশই রয়েছে বরফ হিসেবে। এই অলবণাক্ত পানির বাকি অংশ রয়েছে ভূপৃষ্ঠে ও ভূগর্ভে। এই পানির ৮৩ শতাংশ ব্যবহার হয় কৃষিকার্যে ও বাকি ১৭ শতাংশ শিল্প, গৃহস্থালির প্রয়োজনে।
তাই পৃথিবীর পানিসম্পদ, যা একসময় অফুরন্ত উত্স হিসেবে গণ্য হতো, তা আজ বিরল সম্পদে পরিণত হচ্ছে। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে গোটা পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবের মুখোমুখি হবে। বাংলাদেশের অবস্থা হবে ভয়াবহ। বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। এখনই বিশুদ্ধ পানির ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক হতে হবে সরকারকে। এজন্য বিশুদ্ধ পানির উত্সস্থল নদনদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। বেশি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি বাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহৃত পানি পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
শিল্পকারখানার, পয়োবর্জ্য, বিদ্যুেকেন্দ্র এবং আবর্জনা প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনার বর্জ্য নদী বা জলাশয়ে ফেলা বন্ধ করতে হবে। শিল্পকারখানায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) বাধ্যতামূলক করতে হবে। পানি ব্যবহারে সংযমী হতে জনসাধারণকে উত্সাহী করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার হ্রাস করা এবং ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনী পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করতে হবে। পুকুর, দিঘি, খাল-বিল-নদীসহ যে কোনো জলাশয় ভরাট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।